গাজী কাইয়ুম: ফজলুর রহমান বাবু। বাংলাদেশের অভিনয় জগতের জীবন্ত এক কিংবদন্তি। দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে অভিনয়ে পথ চলা তার। এ সময়টাতে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের যেমনি হাসিয়েছেন তেমনি কাঁদিয়েছেনও। সুদক্ষ এই অভিনেতা চার বার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। নিজের অভিনয় ক্যারিয়ারের বিভিন্ন দিক নিয়ে সম্প্রতি খোলামেলা কথা বলেছেন বাংলাদেশ জার্নালের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গাজী কাইয়ুম…
ফজলুর রহমান বাবু: আমি তারকাখ্যাতি উপভোগ করি না। আমি মনে করি অন্য দশটা পেশার মতোই অভিনয় আমার একটি পেশা। নিজেকে অভিনেতা মনে করি, মানুষ আমার অভিনয় পছন্দ করে, ভালোবাসে এইটা আমার কাছে জীবনের অনেক বড় প্রাপ্তি। অভিনয় করে অনেক মানুষের ভালোবাসা, সমর্থন ও প্রশংসা পেয়েছি। মানুষ আমাকে অভিনেতা হিসেবে সম্মান করে এটা অনেক বড় পাওয়া। সে জন্য আমার দর্শক, শ্রোতা যারা আছেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। মানুষ আমাকে ভালোবাসে বলে আমার অনেক দায়িত্বও রয়েছে। দর্শকদের সাথে আমি সবসময় ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করি।
বিজ্ঞাপনে কাজের অভিজ্ঞতা যদি একটু শেয়ার করতেন?
ফজলুর রহমান বাবু: অভিজ্ঞতা ভালো, বিজ্ঞাপন ক্যারিয়ারের জন্য কিছুই না। আমি অভিনয় দিয়ে একটা ক্যারিয়ার তৈরি করেছি, মানুষ আমাকে চেনে জানে, আমার এক ধরণের দর্শক শ্রেণি আছে। সেই জায়গা থেকে যারা পণ্য তৈরি করে তারা মনে করে একজন মডেল বা অভিনেতা-অভিনেত্রীকে দিয়ে তাদের প্রডাক্ট প্রমোট করবে।
তারকাদের বিজ্ঞাপন দেখে তার ভক্ত বা দর্শক সেই পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়, কিন্তু দেখা যায় সেই সব প্রতিষ্ঠান যখন তাদের গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করে তখন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সবাই তাকে নিয়ে আলোচনা করে; সেক্ষেত্রে তারকাদের বিজ্ঞাপনে চুক্তির ক্ষেত্রে করণীয় কি?
ফজলুর রহমান বাবু: এই ক্ষেত্রে তারকাদের কিছু করার নেই। তারকাদের তো চুলচেরা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞাপনে কাজ করা সম্ভব নয়। তবে বাংলাদেশে সম্প্রতি যেসব ঘটনা ঘটেছে এর পরে মন হয় আমাদের একটু সতর্ক থাকা দরকার। কিছুদিন আগে মাশরাফিকে নিয়ে মানুষ আলোচনা করেছে এটা আসলে কাম্য না, দায়দায়িত্ব তো ওর না, দায়ভার সম্পূর্ণ ওই কোম্পানির। মাশরাফিকে সবাই ভালো খেলোয়ার ও মানুষ হিসেবে জানে। সে একটি দায়িত্বশীল জায়গায় (সংসদ সদস্য) আছে। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মডেল বা তারকাদের সতর্ক থাকতে হবে, সচেতন থাকতে হবে। আর চুক্তি করার আগে কোম্পানির সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নেয়া ভালো।
নাটকে নিয়মিতই অভিনয় করছেন। গানে কেন নিয়মিত নন?
ফজলুর রহমান বাবু: আমি তো আসলে নিজেকে গায়ক মনে করি না। আমি এত বেশি গান করতেও চাই না। গানের জন্য আলাদা আলাদা কাজ, চর্চা ও অনুশীলন করতে হয়। যেহেতু আমি নিজেকে অভিনেতা মনে করি, সেহেতু আমি অভিনয় করতে চাই। একদম ফর্মেটের ছবি বা ফর্মুলার ছবি অহেতুক হাসি, কাতুকুতু এই ধরণের কোন নাটক সিনেমা আমি করি না আর করতে চাইও না।
নাটকে ভিউ প্রতিযোগিতার গল্প শোনা যায়। আপনি তো সিনিয়র অভিনেতা; ব্যাপারগুলো কীভাবে দেখেন?
ফজলুর রহমান বাবু: এটা আসলে বাস্তবতা। আমি মনে করি, একটি ভালো নাটকেরও অনেক ভিউ হতে পারে, আবার খারাপ নাটকেরও অনেক ভিউ হতে পারে। ভিউ নির্ভর করে দর্শকের ওপর, কেমন দর্শক দেখছে সেটার ওপরে। ভালো কাজের ভিউ হলে বুঝবেন সেগুলো ভালো মানুষ দেখছে আর খারাপ কাজের ভিউ হলে সেগুলো ওই ধরণের দর্শক দেখে। তাছাড়া প্রবীণ দর্শক এক ধরণের কাজ পছন্দ করে আর অপেক্ষাকৃত তরুণ যারা তারা এক ধরণের কাজ পছন্দ করে। তবে টেলিভিশন কোম্পানি বা নির্মাতা বা এজেন্সির কিছু দায়দায়িত্ব থাকে। সেই দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। ভিউ বেশি হবে বলে যে জিনিসটা বানাতে হবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। ভালো কাজ করলেও ভিউ বেশি তার প্রমাণ কিন্তু আছে।
সবাই এখন ওটিটি প্ল্যাটফর্মের দিকে ঝুঁকছে, একজন অভিনেতা হিসেবে বাংলাদেশে ওটিটির কেমন ভবিষ্যৎ দেখছেন?
ফজলুর রহমান বাবু: আমি ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে পজেটিভ ভাবে দেখি। একসময় মানুষ শুধু মঞ্চে নাটক দেখতো, তার পর টেলিভিশনে নাটক দেখা শুরু করল। এগুলো একেকটা প্ল্যাটফর্ম, ওটিটিও তেমনই একটি প্ল্যাটফর্ম। এই প্লাটফর্মে অনেক কাজ থাকে। সেই জায়গা থেকে মানুষ টাকা দিয়ে ভালো কাজ বা পছন্দের কাজ গুলো দেখতে পাবে।
আপনার ক্যারিয়ার শুরু মঞ্চ নাটক দিয়ে। করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘ দেড় বছর মঞ্চ নাটক বন্ধ থাকার পরে আবার শুরু হচ্ছে; সেক্ষেত্রে কিভাবে মঞ্চ নাটক আবার আগের অবস্থানে ফিরতে পারে?
ফজলুর রহমান বাবু: করোনা কবে স্বাভাবিক হবে জানি না বা কেউ বলতে পারে না। তবে আমাদেরকে এই ধরণের আয়োজন যেখানে একসাথে অনেক দর্শক বসে সিনেমা দেখবে বা মঞ্চ নাটক বা স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখবে; এককথায় অনেক মানুষের সমাগম হয় সেখানে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তা না হলে হয়তো আবার বড় ধরণের ঝুঁকিতে পড়তে হবে। সে জায়গা থেকে আমি মনে করি করোনার যে বাস্তবতা সেটা মাথায় রেখে কাজগুলো করতে হবে। বাস খুলে দিয়েছে, স্কুল-কলেজ ও মার্কেট খোলা আছে সব চলছে সেক্ষেত্রে থিয়েটর খুলে দেয়া উচিত। আর থিয়েটারের মূল বিষয় হলো দর্শক, দর্শক না আসলে তো থিয়েটার হবে না, একা একা তো মঞ্চে নাটক করতে পারবো না। দর্শকদেরও আমাদের আশ্বস্থ করতে হবে যে আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে মঞ্চে নাটক করছি এবং ভালো কাজ করছি। তবে আমি আশাবাদী খুব দ্রুত সব ঠিক হবে।
আমরা জানি দীর্ঘ তিন যুগের বেশি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। অভিনয় জীবনে অপূর্ণতা আছে কিনা?
ফজলুর রহমান বাবু: না, আমার কোনও অপূর্ণতা নেই। অপূর্ণতা নিয়ে ওভাবে ভাবিও না। এক জীবনে তো সবকিছু করা সম্ভব নয়, জীবনের তো সীমা রয়েছে। আমার জীবনে যতটুকু সম্ভব আমি করছি। তবে হ্যাঁ, আমার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আরও ভালো ভালো কাজ করার, আরও বড় জায়গায় কাজ করার। এক জীবনে তো আর সব পূরণ হয় না। তার মধ্যেও যতটুকু সময় পাবো ভালো কাজের সাথে যুক্ত থাকবো, ভালো কাজ করার চেষ্টা করবো।
বর্তমানে নাটক না চলচ্চিত্র, কোন মাধ্যমটা এগিয়ে আছে?
ফজলুর রহমান বাবু: বাণিজ্যিক সিনেমা এগিয়ে থাকার উচিত ছিলো। আমরা আসলে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি সেটা আমাদের ব্যর্থতা। ৫০ বছর ধরে একই রকম বা একই ধরণের সিনেমা বানাতে থাকি তাহলে মানুষ দেখবে কেনো; মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়েছে, মানুষ অনেক আধুনিক হয়েছে, অনেক বেশি শিক্ষিত হয়েছে। সেই জায়গা থেকে সময়ের সাথে মিল রেখে বাণিজ্যিক সিনেমা বানালে এই ব্যর্থতা দূর হবে।
আপনি ক্যারিয়ারের একটা পর্যায়ে গিয়ে নির্মাণের স্বপ্ন দেখেন কিনা?
ফজলুর রহমান বাবু: না; আমি অভিনেতা, অভিনয় করে যেতে চাই।